মা তার মেঘে ঢাকা তারা।
শুভ্র মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে তখন। হঠাৎ এক সকালে বাবা তাকে ফোন দিয়ে জানান মা নাকি কিছুটা অসুস্থ। শুভ্র সেদিনই class বাদ দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেয়। বাড়িতে গিয়ে দেখে মা বিছানায় শুয়ে আছেন, চোখ মুখে অসহ্য যন্ত্রণার ছাপ (vague abdominal discomfort), পেটের দুপাশে চিনচিনে ব্যথা (loin pain)। প্রসাবে ভীষণ জ্বালাপোড়া (UTI), প্রসাবের রঙটাও রক্তের মত টকটকে লাল (Hematuria)। মায়ের মাথাটা ভীষণ ধরা থাকে, রাতে ভাল ঘুম হয়না। শুভ্র তার ব্যাগে থাকা বিপি স্টেথো দিয়ে pressure মেপে দেখে hypertension!
শুভ্রর মাথাটা একটু ঝিমঝিম করে। কোন এক পরিচিত রোগের সাথে যেন symptoms গুলো মিলে যাচ্ছে। তবে নিশ্চিত হতে পারছে না। মনে মনে প্রার্থনা করছে খারাপ কিছু যেন না হয়। পরদিনই মাকে নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে৷ তিনি সব শুনে প্রসাবের একটি test (urine R/E) আর পেটের একটা ultrasonogram করতে দেন। Report হাতে এলে দেখা যায় প্রসাবে অসংখ্য RBC, RBC cast; আর ultrasonogram এ দুটো kidney জুড়ে অসংখ্য ছোট বড় cyst।
মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে শুভ্রর যতটুকু যা জ্ঞান আর স্যারের কথোপকথন শুনে ও নিশ্চিত হয়ে যায় এটা Adult Polysystic Kidney Disease (PKD)!
Cyst গুলো একটা বা দুটো kidney তে থাকতে পারে, মায়ের দুটোতেই আছে! শুভ্রর মাথার ভেতরে কেমন ঘুরপাক দিয়ে উঠে!
মায়ের বয়স খুব বেশি না, ৪৫ মাত্র। এ রোগটার শুরু ছোটবেলা থেকেই (infancy or childhood), cyst গুলো আস্তে আস্তে বড় হয় আর symptoms প্রকাশ পায় ২০ বছরের পর থেকে যে কোন সময়। শুরুর দিকে যা থাকে তা শুধুই hypertension, দিন যত যায় ততই অন্যান্য symptoms প্রকাশ পায়। এটা Autosomal dominant in origin.
(তবে Infantile polycystic kidney disease বলে আর একটা cystic renal disease আছে যেখানে শুরু থেকেই symptoms থাকে, এবং সেটা Autosomal Recessive in origin)।
Adult polycystic kidney disease এর কারণ genetic. gene mutation হয়ে এ রোগ হয়।
দুটো gene এর জন্য দায়ী হতে পারে –
- PKD1 বা
- PKD2
PKD1 mutation হয়ে হলে যেটা হয় সেটা বেশি খারাপ!
শুভ্র নিজেকে প্রবোধ দেয়। নিশ্চই মায়ের খারাপ কিছু হবে না। আর এটা তো কোনো ক্যান্সার না। কিন্তু শুভ্র তখনও জানে না এটা কখনো ক্যান্সার থেকেও মারাত্মক হতে পারে।
Cyst গুলো কত তাড়াতাড়ি বড় হয় বা কত বেশি বড় হয় তার উপর নির্ভর করে এ রোগের তীব্রতা। প্রসাবের সাথে রক্ত গেলেও শুরুতে কোন ব্যথা থাকে না (painless hematuria)। কিন্তু যখন cyst গুলোর মধ্যে রক্তক্ষরণ হয় তখন প্রচণ্ড ব্যথা থাকে (painful hematuria)। অর্থাৎ এটি একই সাথে painless ও painful দু রকম hematuria নিয়ে present করে!
শুভ্রর মায়ের creatinine তখন normal। ডাক্তার তাদেরকে টেনশন করতে বারণ করেছেন। শুভ্র আশায় বুক বাঁধে, মা নিশ্চই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। সে আবার ঢাকায় ফিরে আসে, ব্যস্ত হয়ে পড়ে পড়াশোনায়।
সামনে final prof, ডাক্তারি পাশ করার সর্বশেষ কঠিন exam। এরমাঝে ছুটিতে একদিন বাড়িতে গেলে মা আবার তাকে পেটে ব্যাথার কথা বলে। ছুটি শেষে শুভ্র তাই মাকে নিয়ে হাজির হয় ঢাকায়। Nephrologist স্যারের সাথে কথা বললে, সবকিছু দেখে তিনি অল্প কিছু ওষুধ দেন আর follow up এ থাকতে বলেন। Creatinine তখনো normal।
ইতোমধ্যে শুভ্র MBBS পাশ করে internship শুরু করে, আর তখনই হঠাৎ করে মা আবার অসুস্থ হয়ে যায়। Duty ফেলে বাড়িতে গিয়ে দেখে মায়ের চোখ মুখ ফোলা, পেটটাও একটু ফোলা। নিজেই creatinine করেই দেখে অনেক বেশি। শুভ্র ভেবে পায়না কি করবে। তবে কি তার ভয়টাই সত্যি হতে যাচ্ছে!
ওদিকে বাবারও বয়স হয়েছে, বাড়িতে একটা মাত্র ছোট বোন। বাড়ির একমাত্র ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব তারই। শুভ্র জানে স্যাররা এখন কি বলবে, তার মায়ের renal failure develop করেছে।
মায়ের এখন যা প্রয়োজন তা হল Hemodialysis। শুভ্র মাকে নিয়ে আবার ঢাকা যায়, urology department এ এনে dialysis এর জন্য মায়ের হাতে fistula করিয়ে রাখে। Ultrasonogram এ মায়ের cyst গুলো বেশ বড় তখন, আর পেটটাও ভীষণ ভারী। এই শরীর নিয়ে মাকে নিয়ে বারবার ঢাকায় যাতায়াত করা বেশ কষ্টকর। শুভ্র তাই নিজ শহরের dialysis center এ যোগাযোগ করে। সেখানের স্যররা তখনই dialysis শুরু করতে বললেন। সপ্তাহে তিন দিন চার ঘন্টা করে। প্রতি শনি সোম বুধবার মায়ের dialysis চলতে থাকে। চলছে তো চলছে, এভাবে চলতে থাকে।
সীমাহীন কষ্টকর এই চিকিৎসা প্রক্রিয়া, শুভ্র তখনও জানে না মায়ের এ কষ্টের শেষ কোথায়!
BCS দেওয়ার পর শুভ্রর posting হয় বাড়ির কাছেই সরকারী হাসপাতালে। Duty ছাড়া পুরোটা সময় শুভ্র মায়ের কাছেই থাকে। বেতন যা পায় তা দিয়ে চিকিৎসার যতটুকু যা করা যায় তার সবই সে করে।
কিন্তু দিনে দিনে cyst গুলো আরো বড় হতে থাকে, মায়ের পেটটা ভীষণভাবে ফুলে যায়। হঠাৎই একদিন মায়ের ভীষণ শ্বসকষ্ট শুরু হয়। cyst এর pressure effect এ মায়ের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারে। আবার একটা ultrasonogram করা হয়৷ সেখানে দেখা যায় liver এও বেশ কিছু cyst। 30% ক্ষেত্রে renal cyst সাথে hepatic cyst নিয়ে present করে। তবে liver function normal থাকে, liver বড় হয় শুধু। আর এটা মহিলাদের বেশি হয়।
Cyst গুলোর pressure effect কমানো যায় কিনা সেটা চিন্তা করে cyst এর ultrasonogram গাইডেড fluid aspiration এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। Aspiration এর সময় দেখা যায় fluid এর সাথে blood আসছে, তাই aspiration আর continue করা হয় না।
মায়ের আগে থেকেই anaemia ছিল, এর সাথে যদি blood mixed fluid aspiration করা হয় তবে cyst এর ফাঁকা জায়গায় আবারো নতুন করে bleeding হবে, এতে anaemia আরো বাড়বে। cyst গুলো drain না করায় মায়ের কষ্টটাও কমানো গেলো না।
Erythropoietin injection প্রায়শই push করা হয় anaemia কমানোর জন্য। সবকিছুর পরেও মা খুব একটা ভাল ছিল না। আর কি করা যায়, সেগুলো নিয়ে শুভ্র অনেক ভাবলো। কিন্তু একটা চিন্তা কেন জানি শুভ্রর গভীরভাবে করা হয়নি, স্যাররাও কখনো বলেনি এ ব্যাপারে, আর সেটা হল kidney transplant!
মায়ের বেশ কষ্ট হতো, কিন্তু মুখ ফুটে তেমন কিছুই বলতো না। এদিকে শুভ্রর transfer হয়ে যায়। বাড়ি থেকে দূরে। সেখানে বেশ কাজের ব্যস্ততা, তবুও যখনই ছুটি পায়, ক্ষণিকের জন্য ছুটে আসে মাকে দেখতে।
মায়ের গতানুগতিক চিকিৎসার ভরসায় শুভ্র ঘুণাক্ষরে ভাবতে পারেনি মায়ের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, নতুন কিছু ভাবতে হবে, করতে হবে নতুন কিছু। সব কিছু ছাপিয়ে কিভাবে যেন কিছুটা দিন পার হয়ে যায়। মায়ের kidney ততদিনে পুরোটাই non-functional হয়ে গেছে, dialysis চলছে নিয়মিত।
Kidney দুটো তখন বেশ বড়। তাই এক পর্যায়ে চিন্তা করলো, dialysis যেহেতু চলছেই সেহেতু এই ভারী কষ্টদায়ক kidney রেখে কি হবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় nephrectomy করার, এতে হয়তো মায়ের কষ্ট কিছুটা কমবে। কিন্তু nephrologist যাদেরকে দেখালো তারা কেউ এ ব্যাপারে তেমন positive কিছু বললেন না, আশংকা করলেন nephrectomy করতে যেয়ে যদি OT টেবিলে কিছু হয়, তার থেকে এখন যেমন চলছে তেমনই চলুক। চলতে থাকলো এভাবে আরো কিছুদিন।
শুভ্র সেদিন duty তে। হঠাৎ বাবার ফোন, receive করতেই ওপাশ থেকে, “তোর মা খুব অসুস্থ, তাড়াতাড়ি বাড়িতে আয়”। শুভ্র তাড়াতাড়ি মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মা তখন ICU তে ভর্তি, শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে, pulmonary edema develop করেছে। এদিকে emergency dialysis করা দরকার, কিন্তু ICU তে কোন portable dialysis মেশিন নেই। সব কিছু চিন্তা করে অন্য কোন উপায় না দেখে হয়ে মাকে ICU থেকে বের করে dialysis এর জন্য মাকে বাইরে নিয়ে আসে, শেষ হলে আবার ICU তে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। মা তখন অজ্ঞান।
মা ICU তে, শুভ্র পাশেই doctors room এ, একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলো। হঠাৎই ICU থেকে কল আসে। শুভ্র ছুটে যায় মায়ের বেডের কাছে। সবকিছু চুপচাপ, নিথর নীরব তার মায়ের চাহনি। নেই, শুভ্রর মা আর বেঁচে নেই। মা, তার ভালবাসার মা, সবকিছু ছেড়ে চলে গেছেন দূরে, অনেক দূরে সেই না ফেরার দেশে। মায়ের নিথর দেহটা কোলে নিয়ে শুভ্র বাড়িতে আসে। মনে মনে অনুতাপ করে আর বলে, ক্ষমা করে দিও মা, আমি তোমার জন্য সবটা করতে পারিনি, আমি তোমাকে kidney দিতে পারিনি, আমায় ক্ষমা করে দিও।
শুভ্রকে সবাই সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু শুভ্র কিছুতেই শান্তি খুঁজে পায় না। লোকে বলে সময়ের সাথে সব নাকি একদিন ভুলে যাবে। সেসব শুনে শুভ্র বলে, মায়ের স্মৃতি কি ভোলা যায়, মা যে আমার ভালবাসার মা।
লেখাটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। সবাই শুভ্রর মায়ের জন্য দোয়া করি।
ডা. কাওসার উদ্দীন
ঢামেক, কে-৬৫
প্ল্যাটফর্ম একাডেমিক /সাঈদা আলম
Pingback: Glomerulonephritis: Types, Symptoms, Complications, Diagnosis & Treatment।। হাবিজাবি ৪৬ – Platform | CME