Blog

বরফ যেখানে শুধুই খাবার

খাবার নিয়ে মানুষের পাগলামি থাকতেই পারে। কিন্তু তাই বলে সেটা কতটুকু? ‘পিকা’ নামক একটি রোগের কারণে মানুষের উদ্ভট উদ্ভট সব খাবারের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি হয়। এতে করে অনেকে সাবানের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ে। খেতে শুরু করে সাবান। অনেকে আবার খাবারের জন্য বেছে নেয় ইট, পোড়া মাটি, টুথপেস্ট- এমন অনেক কিছু। পিকায় আক্রান্ত মানুষের রোগের নাম আবার নিজেদের খাবারের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন হয়। যেমন Pagophagia

অদ্ভুত রোগ Pagophagia! আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত বরফের প্রতি বেশি আসক্ত হয়। কারণে অকারণে বরফ খেতে পছন্দ করে তারা। পিকার মধ্যেই একটি ভাগে Pagophagia কে রাখেন চিকিৎসকেরা। অনেকে মনে করেন, Pagophagia- এর সাথে রক্তশূন্যতায় ভোগার ব্যাপারটি জড়িত। তবে তাই বলে এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেন না। অতিরিক্ত বরফ খাওয়ার পেছনে রক্তশূন্যতার প্রভাব থাকতে পারে বটে, তবে সেটাই যে প্রধান কারণ এবং প্যাগোফেজিয়া যে সেই কারণেই হয় সেটা নিয়ে দ্বিমত আছে। কারণ কেবল শারীরিক সমস্যাই নয়, পিকায় আক্রান্ত রোগীরা মানসিক অবসাদ এবং অন্যান্য কারণেও নানারকম উদ্ভট খাবার গ্রহণ করে থাকেন।

Pagophagia-এর লক্ষণ:
বারবার বরফ চিবুতে ইচ্ছা করা বা বরফ দেওয়া পানীয় পান করাকেই Pagophagia- এর মূল লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়। এই ইচ্ছা যদি আপনার মধ্যে হঠাৎ করে হয় কিংবা কিছুদিনের জন্য হয় তাহলে সেটা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে, আপনি প্রায় এক মাস যাবত এমন বরফ ও বরফজাতীয় খাবারের প্রতি আসক্তি অনুভব করছেন তাহলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে আপনি পিকা’য় আক্রান্ত কিনা সেটা জেনে আসাটা প্রয়োজন।

প্রথমেই বলেছি যে, Pagophagia- এর সাথে Anaemia বা রক্তশুন্যতার বেশ ভালো একটি সম্পর্ক রয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনি Pagophagia তে আক্রান্ত হলে বেশকিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে-

১) অবসাদ এবং দূর্বলতা
২) ত্বক সাদাটে হয়ে যাওয়া
৩) বুক ব্যথা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
৪) মাথা ঘোরা
৫) ঘনঘন পিপাসা পাওয়া এবং অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া
৬) ক্ষুধা না পাওয়া
৭) হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

Pagophagia- এর কারণ:
Pagophagia সাধারণত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তবে তার মানে এই নয় যে, এটি বড়দের হবে না। Pagophagia তে আক্রান্তদের অনেকে বেশ বয়স্ক। অনেকে আবার গর্ভধারণের কারণে Pagophagia তে আক্রান্ত হন। একটি গবেষণায় গবেষকেরা Iron deficiency আছে এমন anaemia তে আক্রান্ত ৮১ জন মানুষের সাথে কথা বলেন। তাদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানতে চান। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মোট ১৩ জনের Pagophagia র সমস্যা ধরা পড়ে। এদের মধ্যে অনেকে Iron supplement নিয়ে থাকেন। তবে তার পাশাপাশি বরফ খাওয়ার ব্যাপারটিও চলতে থাকে। অন্য এক গবেষণায় পাওয়া যায় যে, Pagophagia তে আক্রান্তরা না জেনে হলেও বরফ বেশি পছন্দ করেন এবং গ্রহণ করেন। বেশি বরফ খাচ্ছেন এমন মানুষদের পরীক্ষা করে তাদের Anaemia র সমস্যা আছে বলে জানা যায়। ফলে তাদের মতে, এটি খুব পরিষ্কারভাবে বলা যায় যে, Anaemia এবং Pagophagia- এর মধ্যে খুব দৃঢ় সম্পর্ক আছে।

তবে Anaemia কে প্রধান কারণ বলে মনে করলেও মানসিক অবসাদকেও অনেকে এগিয়ে রেখেছেন কারণ হিসেবে। অসম্ভব মানসিক চাপে থাকলে বরফ খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায় বলে মনে করেন অনেকে। এটি তখন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। তবে কারণ যেটাই হোক, Pagophagia একটি রোগ। আর এই রোগের কোনোরকম ছাপ যদি আপনি নিজের খাদ্যাভ্যাসে দেখতে পান তাহলে এই প্রশ্নগুলো করুন নিজেকে। এতে আপনার চিকিৎসকের সমস্যা ও সমাধান নির্ধারণ করা সহজ হবে।

১। আপনি প্রতিদিন কতখানি বরফ খান?
২। কতদিন ধরে বরফের প্রতি আসক্ত আপনি?
৩। বরফ ছাড়া আর কোনো আসক্তিতে ভুগছেন?
৪। রোগের আর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে আপনার শরীরে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজেই ভালো করে জেনে নিন। তারপর চিকিৎসকের কাছে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া সহজ হবে যে, আপনার আসলে Pagophagia আছে কিনা।

কী করবেন এবং কী করবেন না:
Pagophagia- এর ক্ষেত্রে প্রথমেই আপনার যেটা করা উচিত সেটা হল ভালো করে নিজেকে জানা। রক্তশূন্যতার কারণেই আপনার বরফে আসক্তি হচ্ছে কিনা সেটা জানা দরকার। হতে পারে যে, এমন কিছু হলে আপনি কেবল আপনার রক্তশূন্যতার সমস্যার সমাধান করেই Pagophagia র সমস্যা দূর করতে পারেন। তবে চিকিৎসক না বলা পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াই ভালো। অনেকসময় অনেকে বরফের প্রতি নিজের আসক্তি দেখে নিজেকে Pagophagia র রোগী ভেবে বসেন। আর এর কারণ Anaemia ভেবে নিয়ে iron supplement গ্রহণ করলে তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। কারণ আমাদের শরীর অতিরিক্ত পরিমাণ Iron গ্রহণ করতে পারে না। এতে শরীরে Iron জমে কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্যান্সার বা মারাত্মক কোনো সমস্যা তৈরি হতে পারে।

Anaemia ছাড়াও যদি মানসিক চাপ থেকে Pagophagia র সমস্যা তৈরি হয় তাহলে CBT বা cognitive behavioral therapy ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে মানসিক কোনো সমস্যা থেকে বরফ গ্রহণের সমস্যা তৈরি হলে সেটা দ্রুত চলে যাবে। তবে এ তো গেল Pagophagia- এর ক্ষেত্রে কী ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সেসব কথা। তবে তার আগে আপনার জানা উচিত কেন আপনি এই পদক্ষেপ নিবেন। Pagophagia কি এতই গুরুতর কোনো সমস্যা?

হ্যাঁ, সেভাবে বলতে গেলে ছোটোখাটো থেকে শুরু করে বেশ বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে Pagophagia। যেমন- Pagophagia আপনার দাঁতের বেশ বড় রকমের ক্ষতিসাধন করতে পারে। Pagophagia তে আক্রান্তরা যেহেতু অধিক পরিমাণে বরফ গ্রহণ করেন, ফলে দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়ে যায়। এতে দাঁত অরক্ষিত হয়ে পড়ে। খুব দ্রুত দাঁত নষ্ট হওয়া ও ভেঙ্গে যাওয়ার মতো ব্যাপারগুলো ঘটে।

আর আপনার Pagophagia র কারণ যদি হয় Anaemia, সেক্ষেত্রে বেশ সমস্যায় পড়ে যেতে পারেন আপনি। আপনার হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। আপনার হৃদপিণ্ড বৃদ্ধি পেয়ে সেটা কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে।

আপনি যদি গর্ভবতী হন এবং আপনার যদি Pagophagia র সমস্যা দেখা দেয় তাহলে এর প্রভাব পড়তে পারে আপনার শিশুর উপরেও। আপনার শিশু অনেক আগেই জন্ম নিতে পারে কিংবা তার ওজনে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আর এই Pagophagia যদি শিশুদের ক্ষেত্রে হয় তাহলে শিশুর অসুস্থতার মাত্রা বাড়তে পারে। খুব স্বাভাবিকভাবেই কোনো শিশু যদি অতিরিক্ত পরিমাণ বরফ কিংবা বরফজাতীয় খাবার গ্রহণ করে তাহলে তার দাঁত, শরীর এবং সবকিছুতে এর প্রভাব পড়বে। সে অসুস্থ হবে খুব দ্রুত।

এই পুরো সমস্যা থেকে দূরে থাকতে বেশি করে আয়রনযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন। সেইসাথে মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকুন। কোনো সমস্যা দেখা দিলেই মানসিক সেবা নিন এবং চিকিৎসকের কাছে যান। বরফ খাওয়া চোখে পড়ার মতো বিষয় নয়, বলা যায় মজার ব্যাপার। তবে তাই বলে এই মজার ব্যাপার রোগে পরিণত হতে শুরু করলে সেটাকে গুরুত্ব দিন। সঠিক পদক্ষেপ নিন।

Rahima Akhter Oishye
ShSMC (18-19)

প্ল্যাটফর্ম একাডেমিক/ তাবাসসুম ইসলাম

Leave a Reply