SARS CoV-2 Vaccine এর ইতিবৃত্ত (পর্ব-৭)
অক্টোবর ৪,১৯৫৭।
বাইকানৌর কসমোড্রোম,সোভিয়েত ইউনিয়ন।
মানব ইতিহাসের প্রথম কৃত্রিম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। অদ্ভুত দেখতে বস্তুটির একটা গালভরা নাম দেয়া হয়েছে; স্পুটনিক (SPUTNIK) । বাংলায় যার অর্থ হল “সহযাত্রী”। তৎকালীন সোভিয়েত নিউজ এজেন্সী TASS যতক্ষণে এই খবর পুরো বিশ্বের কাছে পৌছে দিয়েছে ততক্ষণে স্পুটনিক দুবার পুরো পৃথিবীর কক্ষপথ চক্কর দিয়ে ফেলেছে। পুরো পৃথিবী তখন “SPUTNIK MOMENT” এ আচ্ছন্ন; বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র।
১২আগস্ট,২০২০।
মস্কো,রাশিয়া।
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও কাবু হয়ে আছে মাইক্রোমিটার সাইজের এক ভাইরাসের কাছে। তাবৎ দুনিয়ার কাছে যখন কোনো উত্তর নেই, তখনি এলো “SPUTNIK-V” ; SARS CoV-2 এর বিরুদ্ধে প্রথম রেজিস্টার্ড ভ্যাকসিন। এ যেন ক্রান্তিকালের আরেক সহযাত্রী; ৬৩ বছর পরে আরেকটি “SPUTNIK MOMENT“ এর পুনর্জন্ম!
আজকের লেখাটি সেই রাশিয়ার Gamaleya Research Institute of Epidemiology & Microbiology এর কোভিড সহযাত্রী “SPUTNIK V” ভ্যাকসিন নিয়ে।
Mechanism of Action:
এটি একটি Heterogenous, Replication deficient, recombinant adenovirus vector based vaccine। ভ্যাকসিনটিতে ব্যবহৃত হয়েছে জেনেটিক্যালি মডিফাইড Adenovirus type-5 (Ad5) এবং Adenovirus Type-26 (Ad26)। অর্থাৎ এটি একটি দ্বৈত ভেক্টর ভ্যাকসিন। এখন প্রশ্নটি হচ্ছে, কেন?
👉Vector based vaccine গুলোর প্রধান সমস্যা হচ্ছে এই ভেক্টরের বিরুদ্ধে শরীরের ইমিউনিটি। আমরা সচারাচর যে সর্দি কাশি (Common cold) এ আক্রান্ত হই তার অন্যতম কারণ এই Ad-5। যার কারণে আগে থেকে আমাদের দেহে এর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরী থাকে। তো যখন একে ভেক্টর হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন এর নির্দিষ্ট কাজ করার পূর্বেই এটি দেহের ইমিউনিটির কারণে নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক এখানেই বাজিমাত করেছে “SPUTNIK V”। এখানে Ad- 5 এর পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়েছে বিরল ধরনের Ad-26 যার বিরুদ্ধে দেহের পূর্বে তৈরী ইমিউনিটির প্রমাণ বিরল। অক্সফোর্ডের ChAdOx-1 এ এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে ব্যবহার করা হয়েছে শিম্পাঞ্জির adenovirus। তবে এটি এর আগে কখনোই মানুষের দেহে ভ্যাকসিন ভেক্টর হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। এক্ষেত্রে তাই SPUTNIK V ই এগিয়ে।
👉 অন্যদিকে একই ভেক্টর ব্যবহার করে দুটি ডোজ প্রয়োগের ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমবার ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে যে ইমিউনিটি তৈরী হয় তা দ্বিতীয়বারের ডোজটির কার্যক্ষমতাকে হ্রাস করে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার SPUTNIK V এই সমস্যাটিকেও পাশ কাটিয়ে গিয়েছে।
Ad-5 এবং Ad-26 রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে তৈরী করা হয় rAd5 এবং rAd26 যা মানবদেহকে আক্রান্ত বা বংশবৃদ্ধি করতে অক্ষম। মূলত এটি ভেক্টর বা ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এরপর rAd5 ও rAd26 এর ডিএনএ এর সাথে করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন এর RNA যুক্ত করে দেয়া হয়। তৈরী করা হয় rAd5-S এবং rAd26-S। এরপর এটি মানবদেহে Deltoid muscle এ প্রয়োগ করা হয় (Intramuscularly) । মানবদেহে প্রবেশের পর ভেক্টর থেকে স্পাইক প্রোটিনের RNA কোষের সাইটোপ্লাজমে মুক্ত হয়। কোষের রাইবোজোম এই RNA থেকে স্পাইক প্রোটিন তৈরী করে। এটি দেহে Foreign particle হিসেবে বিবেচিত হয়। যেহেতু Muscle cell কোনো Antigen presenting cell নয়, তাই Muscle cell; MHC-I এর সাহায্যে স্পাইক প্রোটিনটি Naive T cell এর কাছে উপস্থাপন করে। IL-4 এর উপস্থিতিতে Naive T cell, Helper T cell এ পরিণত হয়। Helper T cell থেকে IL-4 এবং IL-5 রিলিজ হয়; যার উপস্থিতিতে B cell; Plasma cell এ রূপান্তরিত হয়। এই Plasma cell থেকে পরবর্তীতে স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরী হয়। পরবর্তী সংক্রমণে দেহ দ্রুতই এন্টিবডি তৈরী করতে পারে। এভাবেই ভ্যাকসিনটি আমাদের দেহে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। অর্থাৎ,
rAd5 & rAd26 + Spike protein RNA
⬇
Intramuscular vaccination in Deltoid muscle
⬇
Release of RNA of spike protein in the cell cytoplasm
⬇
Synthesis of spike protein in the cell (as a foreign particle)
⬇
Antigen presentation by MHC-I to Naive T cell
⬇
Production of Helper T cell (In presence of IL-4)
⬇
Conversion of B cell into Plasma cell (In presence of IL-4 and IL-5)
⬇
Antibody production
⬇
Immunity
এছাড়া,ভ্যাকসিনটিকে দুইটি ফর্মুলেশনে তৈরী করা হয়েছে;হিমায়িত বা ফ্রোজেন (Gam-Covid-Vac) এবং লায়োফিলাইজ (Gam-Covid-Vac-Lyo)। ফ্রোজেন ফর্মুলেশন 0.5mL ডোজে এবং লাইয়োফিলাইজ ফর্মুলেশন 1mL মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়।
Trial:
১৮ জুন থেকে ৩ আগস্টের মধ্যে রাশিয়ার Burdenko এবং Sechenov Hospital এ ভ্যাকসিনটির Phase I/II ট্রায়েল শেষ হয়। এটি ছিলো Non randomized open labeled Study যাতে ভ্যাকসিনটির Safety & Immunogenicity যাচাই করা হয় । প্রথমে ১২০ জনকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয় যাদের বয়স ১৮-৬০ এর মাঝামাঝি। এদের মধ্যে থেকে কিছু মানদন্ডের ভিত্তিতে দুটি স্টাডির (দুই ধরনের ফর্মুলেশন পরীক্ষার জন্য) জন্য ৩৮ জন করে মোট ৭৬ জনকে শনাক্ত করা হয় যাদের মধ্যে ৫৩ জন (৭০%) পুরুষ এবং ২৩ জন (৩০%) নারী। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ২জন ছিলেন এশিয়ান। বাকি সবাই ছিলো ইউরোপিয়ান বংশদ্ভূত। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে থেকে Phase-I এর জন্য ২ জন এবং Phase-II এর জন্য ৩ জনকে ব্যাকাপ হিসেবে রাখা হয়।
Phase-I এ ফ্রোজেন ফর্মুলেশনে rAd26-S অথবা rAd5-S ৯ জন করে মোট ১৮ জনের দেহে প্রয়োগ করা হয়। লাইয়োফিলাইজ ফর্মুলেশনের ক্ষেত্রেও একই ভাবে ১৮ জনের দেহে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়।
Phase-II এ ফ্রোজেন ফর্মুলেশনটি ২০জনের ওপর প্রয়োগ করা হয়। Day-0 এ rAd26-S প্রয়োগের ২১ দিন পর rAd5-S প্রয়োগ করা হয়। লাইয়োফিলাইজ ফর্মুলেশনটিও একই ভাবে ২০ জনের ওপর প্রয়োগ করা হয়।
Phase-I এ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রথম ডোজের পর ২৮দিন পর্যন্ত এবং Phase-II এ প্রথম ডোজ প্রয়োগের পর ৪৩ দিন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। Phase-I এর ১৪ তম দিনে rAd26-S এবং rAd5-S এর জন্য Seroconversion rate ছিলো যথাক্রমে ৮৮.৯% এবং ৮৪.২%। ২১ দিনের মাথায় যেটা ১০০% অব্দী পৌছায়। Phase-II এ ১৪ তম দিনে ৮৫% এবং ২১তম দিনে তা পৌছায় ১০০% এ। ২৮ তম দিনে Phase-I & Phase-II উভয়ক্ষেত্রেই Humoral & Cell mediated immunity শনাক্ত করা হয়। ৪৩ তম দিনে Phase-II এর স্বেচ্ছাসেবকদের দেহে এন্টিবডির পরিমাণ ছিলো Convalescent plasma এর প্রায় ৮-১০ গুণ। ১০০% স্বেচ্ছাসেবকের দেহে Phase-I & Phase-II এ Neutralizing Antibody শনাক্ত করা হয়।
Phase-I & Phase-II উভয়ক্ষেত্রেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিলো সামান্য। যেমনঃ
Pain (at injection site) – ৪৪ জন (৫৮%)
Hyperthermia – ৩৮ জন (৫০%)
headache – ৩২ জন (৪২%)
Asthenia – ২১ জন (২৮%)
Muscle & Joint pain – ১৮ জন (২৪%)
কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ ভ্যাকসিন ট্রায়ালের কিছু দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছেন।
ফ্রোজেন ফর্মুলেশনটি শুধুমাত্র রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বাছাইকৃত কয়েকজনের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে যারা সবাই ছিলো তরুণ। স্বভাবতই তাদের দেহের ইমিউনিটি গড়পড়তা মানুষের থেকে বেশি।
Phase-I & Phase-II এ মাত্র ২ জন এশিয়ান অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
নারী-পুরুষের সংখ্যার একটি অসামঞ্জস্য দেখা গিয়েছে
এই দুর্বলতাগুলো দূর করতে প্রায় ৪০০০০ জন এর অধিক স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে ট্রায়াল এর Phase-III সম্পন্ন হবে। ২৬ আগস্ট থেকে স্বেচ্ছাসেবক নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হয়। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় ৫৫০০০ স্বেচ্ছাসেবক নিবন্ধিত হয়েছেন। Phase-III এর প্রাথমিক ফলাফল অক্টোবর বা নভেম্বর নাগাদ জানা যাবে।
কিছু দুর্বলতা থাকলেও ভ্যাকসিনটির স্বপক্ষেও কিছু শক্ত যুক্তি রয়েছে। কোনো Registered Vaccine এ এর আগে কখনোই mRNA এবং শিম্পাঞ্জি এডিনোভাইরাস ব্যবহৃত হয়নি। যার ফলে ক্যান্সার সৃষ্টিতে এর কোনো ভূমিকা আছে কিনা বা প্রজননতন্ত্রের ওপর এর প্রভাবের ওপরে আমরা এখনো সেভাবে কিছুই জানতে পারিনি। অন্যদিকে Vector based vaccine এর ধারণাটি অনেক পুরনো। ১৯৫৩ সাল থেকে এই পদ্ধতির ওপর প্রায় ২৫০ টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে এবং ৭৫ টি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে যা এর সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। এছাড়া Adenovirus vector based vaccine প্রযুক্তিটিও পরীক্ষিত। ১৫ বছর ধরে এই প্রযুক্তিটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চীন ১২ বছর ধরে প্রযুক্তিটি নিজেদের ইবোলা ভ্যাকসিনে ব্যবহার করে আসছে। এছাড়া ভ্যাকসিনটির লাইয়োফিলাইজ ফর্মটি সহজে রেফ্রিজারেশন করে সংরক্ষণ করা সম্ভব যা কিনা আমাদের দেশের Vaccination Infrastructure এর জন্য একদম মানানসই।
১৯৫৭ সালের “SPUTNIK MOMENT” পাল্টে দিয়েছিলো ইতিহাসের গতিধারা। এর মাত্র ১২ বছরের মাথায় মানুষ পা রেখেছিলো চাঁদে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এসেছিলো আমূল পরিবর্তন। এটি নিয়ে ভূরাজনৈতিক খেলাও হয়েছে অনেক যার সমাপ্তি হয় ৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে। সময়ের হাত ধরে আবার ফিরে এসেছে সেই “SPUTNIK MOMENT” যেখানে আমরা সবাই আশাবাদী। ভূরাজনীতির কঠিন মারপ্যাচের মাঝেও হয়ত বেচে যাবে অনেকগুলো প্রাণ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরো এগিয়ে যাবে এই বিশ্ব, পরবর্তী যেকোনো দুর্যোগে আমরা থাকবো আরো প্রস্তুত।
After all, “The end is the beginning and the beginning is the end”
Reference:
https://sputniknews.com/science/202009041080363522-the-lancet-publishes-results-of-russian-covid-19-vaccine-clinical-trials/
https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(20)31867-5/fulltext
https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(20)31866-3/fulltext
https://www.aljazeera.com/news/2020/08/sputnik-russia-coronavirus-vaccine-200813070859021.html
https://www.thelancet.com/journals/lanres/article/PIIS2213-2600(20)30402-1/fulltext
https://www.thelancet.com/journals/lanres/article/PIIS2213-2600(20)30402-1/fulltext
মোঃ আদিব সিদ্দিকী
হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ
সেশন: ২০১৭-১৮