Blog

লেখক অরণ্য রায়ের মৃত্যুঃ Suicide or Homicide?

সকালবেলা খবরের কাগজ আর এক কাপ চা দিয়ে দিনটা শুরু না করলে নিজেকে সারাদিন কেমন যেন অসম্পূর্ণ লাগে। গত শনিবারও তেমন কোনো কাজের চাপ না থাকায় আমি বেশ আয়েশ করেই খবরের কাগজ পড়ছিলাম। অরণ্য রায়ের লেখা একটি আর্টিকেল কাগজে বেরিয়েছে। সেটাই পড়ছিলাম। কী ভালো লেখেন উনি!

এমন সময় ইন্সপেক্টর চৌধুরীর ফোন এলো এবং একটি অত্যন্ত বিস্ময়কর দুঃসংবাদ দিলেন। লেখক ও সাংবাদিক অরণ্য রায় তার নিজ বাসভবনে মারা গেছেন। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা তিনি গলা কেটে আত্মহত্যা করেছেন। চৌধুরী আমাকে আমার টিম সহ তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে যেতে বললেন crime scene inspection এর জন্য।

হম্বিতম্বি করে ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম। ইন্সপেক্টর চৌধুরী আমাকে তার বেডরুমে নিয়ে গেলেন। রুমে ঢুকতেই দেখি একজন মধ্যবয়সী লোক রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে। তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যার লেখা আজ সকালেই পড়ছিলাম, সেই মানুষটিই আর নেই!

ইন্সপেকশন শুরু করলাম। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম মেঝেতে বডির আশেপাশে কোনো ফুটপ্রিন্ট নেই। তানিয়াকে বললাম,

“এই রুমের সব ফিঙ্গারপ্রিন্ট কালেক্ট কর।”

ওদিক থেকে ইমরান বলে উঠলো,

” স্যার দরজার লক, জানালা সব ভালো করে চেক করেছি। সব ঠিকঠাকই আছে। এই রুমে কোনো ফোর্সফুল এন্ট্রি হয় নি।”

আমি পুরো রুমটা ভালো মতো দেখলাম। রুমের সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। অস্বাভাবিক কিছু নজরে এলো না। দেয়ালের দিকে তাকাতেই অরণ্য রায়ের একটি ছবির দিকে চোখ পড়লো। আপন মনেই কিছুক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এমন সময় চৌধুরী এসে জিজ্ঞাসা করল,

“কী মনে হচ্ছে?”

আমি বললাম,

“Circumstantial evidence, বডির পজিশন এবং crime scene পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে এটা সুইসাইড। বাকিটা autopsy র পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। আমি mortuary তে যাই তাহলে। এখানে আমার কাজ আপাতত শেষ।”

এবার autopsy র পালা। প্রথমেই খুব নিখুঁতভাবে external examination করলাম। বডির কোথাও কোন ধরনের ইনজুরি নেই। নেই কোনো defense wound।

বডিতে rigor mortis ডেভেলপ করে গেছে। গলার কাটা জায়গাটার রক্ত কালচে হয়ে গেছে। তার মানে, মোটামুটি ১০-১২ ঘণ্টা আগেই অরণ্য রায় মৃত্যুবরণ করেছেন। হাত দুটো examine করতে গিয়েই লক্ষ্য করলাম ডান হাতের মুঠোয় কিছু একটা খুব শক্ত করে ধরে রেখেছেন। আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে খুব জোর জবরদস্তি করে তার হাতের মুঠো খুলতে সক্ষম হলাম, এবং খুলতেই দেখি তার হাতে একটি রেজার ব্লেড। পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হলাম এটি দিয়েই গলা কাটা গিয়েছে। যেহেতু weapon টি ওনার হাতেই পাওয়া গেছে এবং তাতে অন্য কারো ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই, তাহলে আপাতত ধরা যেতে পারে উনি সুইসাইড করেছিলেন।

তারপর magnifying glass দিয়ে cut throat injury examine করতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম, গলার ডান দিকে ৮-১০ টি ছোট ছোট সুপারফিসিয়াল cut mark। অর্থাৎ hesitation / tentative cut mark। Hesitation cut marks indicate the indecisive state of mind। অতএব, সুইসাইডের আরেকটি প্রমাণ পেয়ে গেলাম।

এবার wound এর লোকেশন নিয়ে বলি।এই incised wound টি থাইরয়েড কার্টিলেজের উপরে অবস্থিত ছিল এবং এর ডিরেকশন ছিল above-downwards from left to right। উল্লেখ্য গলার ডান দিকের কাটার গভীরতা বাম দিকের তুলনায় বেশি ছিল। এগুলো সব সুইসাইডাল cut throat injury র typical finding।

এতো এতো প্রমাণ পেয়েও আমি মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না, যে এটা সুইসাইড। কোথায় যেন একটা খটকা।

সুইসাইডাল cut throat injury তে সচরাচর external jugular vein কেটে যায়। এক্ষেত্রে death occurs due to formation of air embolism। হোমিসাইডাল cut throat injury তে গলার সব স্ট্রাকচার, তথা external jugular vein, carotid artery এবং trachea কাটা পড়ে। Trachea কাটা পড়ায় প্রচুর পরিমাণে রক্ত lungs এ চলে যায় and the person dies by drowning in his own blood।
অরণ্য রায়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি ঘটেছিল। তবে সুইসাইডে যে কখনই trachea কাটা যেতে পারবে না তা নয়। তবে তা বিরল। এরপর নিয়ম মাফিক internal examination সম্পন্ন করলাম এবং chemical examination এর জন্য heart, lung, kidney পাঠিয়ে দিলাম।

যদিও সকল তথ্য-প্রমাণ আত্মহত্যার দিকেই ইঙ্গিত করছিল, তবুও কোথায় যেন একটা খটকা লাগছিল। বারবার আমার মন বলছিল এটা সুইসাইড না। Clear thinking করা দরকার। তাই কিছুক্ষণের জন্য mortuary র বাইরে গেলাম। অন্যমনষ্ক হয়ে সাইনবোর্ডটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
“Let the conversation cease
Let the laughter flee
This is the place where
Dead delights to serve the livng.”

হঠাৎ মাথায় একটা বিষয় স্ট্রাইক করল এবং আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,

“My instincts were right! এটা সুইসাইড না। ঠান্ডা মাথায় অরণ্য রায়কে খুন করা হয়েছে। এবং কীভাবে করা হয়েছে সেটাও আন্দাজ করতে পারছি।”

আমি অরণ্য রায়ের বেডরুমে যেই ছবিটির দিকে চেয়ে ছিলাম, সেই ছবিটিতে তিনি তার ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন। কলমটা ধরেছিলেন বাম হাতে। অতএব তিনি left-handed ছিলেন।

অরণ্য রায় যদি সত্যিই গলা কেটে সুইসাইড করতেন, সেক্ষেত্রে left-handed হওয়ার কারণে –
▪︎ রেজার ব্লেড টা তার বাম হাতে পাওয়া যেতো। ডান হাতে না।
▪︎ Wound এর ডিরেকশন হতো from right side to left side। যা এক্ষেত্রে হয়নি।
▪︎ এবং external jugular vein শুধু কাটা পড়ত। Carotid artery আর trachea কাটা যেতো না।

অতএব অরণ্য রায় আত্মহত্যা করেন নি। তাকে খুন করা হয়েছে।

খানিকক্ষণ পর, ইন্সপেক্টর চৌধুরী আর ইমরান এলো এবং আমার হাতে একটি evidence bag ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“বাড়ির পেছনের দিকে এই ভাঙা কাঁচের বোতলের টুকরোগুলো পড়েছিল।”

আমি আর তানিয়া টুকরোগুলো ভালো করে দেখলাম। এখানে একটি নয়, দু’টি কাঁচের বোতলের টুকরো আছে।

“তানিয়া, কাঁচের গায়ে কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখি। আমার কাজ হয়ে গেলে, কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখবে।”

কাঁচগুলোর গায়ে দুটি পদার্থের সন্ধান মিলল: alcohol আর chloroform। মনে হয় খুন করে পালানোর সময় তাড়াহুড়োতে বোতল দুটি পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। তার মানে, প্রথমে chloroform দিয়ে অজ্ঞান করে সুপরিকল্পিত ভাবে অরণ্য রায়কে হত্যা করা হয় এবং পরবর্তীতে alcohol দিয়ে খুনি ফুটপ্রিন্ট সহ তার সকল চিহ্ন মুছে দেয়। সবকিছু শুনে ইন্সপেক্টর চৌধুরী বললেন,

“ওই বাড়ির পেছনে তো কোন দরজা নেই। তাহলে আসামি নিশ্চয়ই দেয়াল টপকে পালিয়েছে। আর যেহেতু কোনো ফোর্সড এন্ট্রির প্রমাণ পায়নি, তাহলে আমার ধারণা খুনি অরণ্য রায়ের পরিচিত কেও ছিল।”

যে খুন করেছিল, সে যথেষ্ট প্ল্যানিং করেই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তবে সকল অপরাধী কোনো না কোনো evidence ফেলে যায়ই। এই ডান হাত – বাম হাতের গরমিলটা না হলে, আর কাঁচের টুকরোগুলো ফেলে না গেলে হয়তো কোনদিনই প্রমাণ হতো না যে অরণ্য রায়কে খুন করা হয়েছে।

Fahima Hasan
MH Samorita Medical College
2017-18

Leave a Reply