Blog

পেশা পরিবর্তনঃ বাবা মা আমাদের শত্রু নয়

২০০৫ সালের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির কনভোকেশন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিখ্যাত অ্যাপল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস বলেছিলেন,

“তোমরা Dogma তে বাস করোনা; যার অর্থ হল অন্যদের কথামতো নিজের জীবন পরিচালনা করা”।

তিনি আরও বলেছেন যে আমরা কেউ যেন নিজের ভালোবাসার কাজ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত নিজেদের ক্যারিয়ার সেট না করি। পছন্দের কাজকে পেশা হিসেবে নিলে তাতে সফলতা পাবার এবং জীবনে সুখী হবার সম্ভবনা অনেক বেশী। আমাদের সবার উচিৎ নিজেদের ভালোবাসার কাজটি খুঁজতে থাকা এবং সেই পথে এগিয়ে যাওয়া।
চলে যাই সেই ২০০৬ সালে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ক্লাস শুরু করার প্রথম সপ্তাহেই আমি বুঝতে পারি ডাক্তারি পেশাটা আমার জন্য নয়; অথবা আমি এই পেশার জন্য নই! ডাক্তারি একটি মহান পেশা, এই ব্যাপারে আমার কোনও দ্বিমত নেই। আমি আসলে অন্য কিছু করতে চাই। কিন্তু কি, আমি তা জানতাম না। মেডিকালের পুরো সময়টা আমি খুঁজতে থাকি- কোন কাজ টা আমাকে কাছে টানে; যেই কাজটা আমি সারাজীবন করলেও আমি বোর হব না, বরং তার প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়তেই থাকবে! সময়টা ফাইনাল প্রফের ১ মাস আগে- আমি আমার ভালোবাসার কাজটিকে খুঁজে পাই। আমি সিদ্ধান্ত নেই ভবিষ্যতে আমি পাবলিক হেলথ ও রিসার্চে ক্যারিয়ার করব। শুধু তাই নয়! মেডিকেল এ খুঁজে পাওয়া ভালোবাসার মানুষটি যাকে পরবর্তীতে জীবনসঙ্গী করে নেই- সেও একই সিদ্ধান্ত (পাবলিক হেলথ) নেয় এবং এগিয়ে চলে তার গন্তব্যে!
ফাইনাল প্রফ শেষে বাসায় যাই। আব্বু আম্মু কে খুব আগ্রহ নিয়ে বলি আমার স্বপ্নের কথা- আমি ডাক্তারি করবোনা; আমি পাবলিক হেলথ রিসার্চ করব। ওনাদের রিঅ্যাকশন খুব সিম্পল ছিল,

“খবরদার! কখনোই না। আর যেন এইসব ফালতু কথা না শুনি। তুমি মেডিসিনের বড় ডাক্তার হবা”।

আমি চুপ করে থাকলাম। ওই ছুটিতে চোখ দেখাতে গেলাম পরিচিত এক আংকেলের কাছে। আম্মু বলে, “দেখেন তো ভাই!!! ছেলে এইসব কি বলে!!!” আমি উনাকে আমার প্ল্যানের কথা বললাম। উনি সবকিছু শুনে আমাকে রীতিমতো ধবল-ধোলাই দিলেন। আমি আবারো চুপ!
আমি চুপ ছিলাম এই জন্য না যে আমার কোন যুক্তি ছিল না। আমি চুপ ছিলাম কারণ ক্যাডেট কলেজে আমি শিখেছি “কথা নয় কাজ”। সময়টা যুক্তিতর্কের জন্য ছিল না, ছিল নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজে নেমে পড়ার।

আমি কাজে নেমে পড়ি। ইন্টার্নশিপের শুরু থেকেই ইন্টারনেট ঘেঁটে এটা-ওটা পড়তে থাকি, জানতে শুরু করি পাবলিক হেলথ সম্পর্কে। বুঝতে পারি কমিউনিটি মেডিসিন আমাদেরকে কি পরিমাণ অন্ধকারে রেখেছিলো পাবলিক হেলথ সম্পর্কে। কী পরিমাণ ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে আমাদের মনে এই সাবজেক্ট কে নিয়ে! ধন্যবাদ এই অনলাইন দুনিয়াকে; আমি শুরু করি একের পর এক MOOC (Massive Open Online Course), শিখতে শুরু করি পাবলিক হেলথ ও রিসার্চের ব্যাসিক কনসেপ্টগুলো। এরই মধ্যে বেশ কিছু ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কনফারেন্স এর student ambassador হিসেবে কাজ করা শুরু করলাম। দেশের মধ্যে বিভিন্ন কোর্স করা শুরু করলাম icddr,b, James P Grant School of Public Health এবং Statistics Department, Dhaka University থেকে। এরই মধ্যে আব্বু-আম্মুর সাথে ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা এবং বিতর্ক তুঙ্গে। আমি খুব আগ্রহ করে উনাদেরকে আমার সব কর্মকাণ্ড দেখাই, যাতে উনারা মেনে নেন আমার সিদ্ধান্ত। সবকিছু দেখে আব্বু শুধু একটা প্রশ্ন করেছিলেন

“তুমি কি মনে কর এই সব সার্টিফিকেট আর ভলান্টারি কাজ তোমাকে ইন্টার্নশিপ শেষ হবার পর কোন জব দিবে?”

আবারও আমি চুপ হয়ে থাকলাম কারণ আমি কিছুই জানিনা। এটা ঠিক যে আমি অজানার পথে হাঁটছি। এরই মধ্যে আমার জন্য বিভীষিকা হয়ে আসলো ৩৩তম বিসিএস! সরকার একসাথে ৬০০০ এর বেশী ডাক্তার নিবে- এটা অবিশ্বাস্য এবং সবার জন্য গোল্ডেন টিকেট! কিন্তু আমি তো বিসিএস দিবো নাহ। কারণ এটা আমার প্ল্যান এর সাথে ম্যাচ করেনা। আব্বু-আম্মু এইবার আরও সিরিয়াস- বিসিএস দিতেই হবে। আমার সব বন্ধুরা চাকরি পেয়ে যাবে, আর আমি বেকার হয়ে বসে থাকবো- এটাই ওনাদের ভয়। আমার আম্মু বলে বসলেন “বিসিএস না দিলে নাকি আত্মীয়স্বজন বলবে আমি চান্স পাবোনা বলেই দেই নাই!” আমি বলেছিলাম“ ক্যাডেট কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার পরও যদি কেও আমার মেধা নিয়ে সংশয় পোষণ করে তাহলে আমি তাদের ধারণা পরিবর্তন করতে চাই না।” আমি বিশ্বাস করি কোন কিছু পেতে হলে কিছু জিনিস ছেড়ে আসতে হয়- এইটাই জীবনের নিয়ম।
আমি চেষ্টা করতে থাকি। একসময় আল্লাহ মুখ তুলে তাকান। ২০১২ এর নভেম্বর এ ইন্টার্নশিপ শেষেই আমি রিসার্চ জব পেয়ে যাই James P Grant School of Public Health এ। সাথে শুরু করি নর্থ সাউথ এ MPH। এক বছরের মাঝে জয়েন করি icddr,b তে; শেষ করি MPH; ঘুরে আসি University of Cambridge ট্রেইনিং এর জন্য। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর এ চলে আসি Karolinska Institutet, Sweden এ মাস্টার্স করতে এপিডেমিওলজি নিয়ে। (এখনও অনেক দূর পথ বাকী……)
এই মুহূর্তে কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার সফলতায় সবচেয়ে বেশী খুশি কে/ কারা; আমি নির্দ্বিধায় বলব আমার বাবা-মা। হ্যাঁ উনাদের সাথে আমার মতপার্থক্য ছিল- কিন্তু উনারা সবসময় আমার ভালো চেয়েছেন, আমি যেন সফল হই সেই দোয়াই করেন। উনারা ভয় পেয়েছিলেন ক্যারিয়ার পরিবর্তন নিয়ে; তার যথেষ্ট কারণ আছে; ওনাদের কাছে পুরো ব্যাপারটি নতুন ছিল। এমন নয় যে এই দুই বছরে আমার কোন ব্যর্থতা আসেনি! ব্যর্থতা এসেছে এবং তখন উনারা আমাকে ফুল সাপোর্ট দিয়েছেন। এখন উনারা খুশি যে আমি আমার প্ল্যান এ ফোকাসড ছিলাম। আমি মানুষের কথায় কান দেই নাই।
আমার গল্প শেয়ার করার উদ্দেশ্য নিজেকে জাহির করা নাহ। ক্লিনিক্যাল ক্যারিয়ার এর প্রতি অবহেলা বা বিতৃষ্ণা ও নাহ। এর উদ্দেশ্য হল সবাইকে নিজের প্যাশন ও ভালোবাসার কাজটি করার প্রেরণা দেয়া। সেটা হতে পারে মাইক্রো-বায়োলজি, অ্যানাটমি কিংবা রেডিওলজি— যে কোন কিছু, যেটা তোমাদের পছন্দের। স্রোতের বিপরীতে হাঁটার সাহস জোগানো- যদি ইচ্ছে হয়। আমাদের মাঝে অনেকেই ফ্যামিলি ও বাবা-মা কে বাঁধা মনে করে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পথে। এটা কিন্তু ঠিক নয়; বাঁধা যদি কেউ দিয়েই থাকে সেটা আমরা নিজেরা, নিজেদের প্রতি নিজেদের আস্থার অভাব, সাহসের ঘাটতি। আর কিছু নয়। নিজেরা এগিয়ে গেলে বাবা-মা কখনোই বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন না। কারণ, সন্তানের ভালোই সব বাবা-মায়ের কাম্য, আরাধ্য বস্তু।

ডাঃ মোঃ সাজেদুর রহমান শাওন, ব্যাচ-৬৩, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
মাস্টার্স স্টুডেন্ট, ক্যারলিন্সকা ইন্সিটিউট, সুইডেন

বিঃদ্রঃ এই লেখাটি প্ল্যাটফর্ম অনলাইন নিউজ পোর্টাল platform-med.org তে প্রকাশিত হয়েছিল ৫ বছর আগে। লেখকের বর্তমান বিবরণ নিম্নরুপঃ (ফেসবুক পেজ হতে সংগৃহিত)
Currently, I am a DPhil Candidate in Population Health at the Cancer Epidemiology Unit of Nuffield Department of Population Health, University of Oxford. I was trained in medicine at Dhaka Medical College. I completed a Master of Public Health (MPH) from North South University, Bangladesh with Summa Cum Laude. Later I pursued an MSc in Epidemiology at Karolinska Institute, as a Swedish Institute scholar. I also received advanced training in diabetes research from the European Association for the Study of Diabetes (EASD). I am an elected Fellow of the UK Royal Society of Public Health.

Leave a Reply