ধরুন, আপনি এমন একটি কোম্পানির CEO, যার স্টক মার্কেটে শেয়ারের দাম মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে ২৪% বৃদ্ধি পেল এবং সপ্তাহ শেষে দেখা গেল তা প্রায় ৩গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে আপনার কোম্পানি এমন কিছু করে ফেলেছে, যেটা আগে হয়তো বা আর কেউ করেনি বা করতে পারেনি। বলছিলাম Moderna Biotech Company এর কথা। আজকের লেখাটি তাদের সাড়া জাগানো ভ্যাকসিন mRNA-1273 নিয়ে।
তো কি এমন অসাধ্য সাধন করেছিলো Moderna? চলুন সময়ের ছকে বেঁধে দেখে আসা যাক।
• জানুয়ারি ১৩ – ভ্যাকসিন তৈরীর কাজ শুরু করে।
• ফেব্রুয়ারী ৭ – ভ্যাকসিনের প্রথম ব্যাচ তৈরী হয় (মাত্র ২৫দিনে!)।
• মার্চ ৪ – FDA Phase-I ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য অনুমতি দেয়।
• মার্চ ১৬ – Phase-I ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয় (শুরুর মাত্র ৬৩ দিনের মধ্যে!)।
• মে ২৭ – FDA phase-II ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর অনুমতি দেয়।
• জুন মাসে তাদের Phase-II ট্রায়াল সম্পন্ন হয় এবং জুলাই মাসে তাদের Phase-III ট্রায়াল শুরু করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এত দ্রুততর সময়ে ভ্যাকসিনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা খুব সম্ভবত একমাত্র Moderna ই করে দেখিয়েছে। এই দ্রুততার সাথে যখন তাদের ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক ও অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তিকে জুড়ে দেয়া হয়, তখন আসলে বলাই যায় তারা অসম্ভবকেই সম্ভব করছে বা করার পথেই রয়েছে। এখন জেনে নেয়া যাক, ভ্যাকসিনটি কিভাবে কাজ করে।
Mechanism of action:
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের মত এই ভ্যাকসিনের নামটিও এর কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। “mRNA 1273” ভ্যাকসিনে মূলত করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের RNA ব্যবহার করা হয়। প্রথমে করোনা ভাইরাসের জিনোম থেকে স্পাইক প্রোটিনের RNA সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেটিকে একটি mRNA তে পরিণত করা হয়। mRNA টিকে এরপর একটি Lipid nanoparticle এর ভেতরে যুক্ত করে মানবদেহে প্রবেশ করানো হয়। মানবদেহে প্রবেশের পর স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে Lipid nanoparticle কেন?
👉একটুখানি ফিজিওলজি জানা থাকলেই উত্তরটা খুবই সোজা। আমাদের সেল মেমব্রেন লিপিড বাইলেয়ার। এটি চার্জযুক্ত বা পানিতে দ্রবনীয় কিছুকেই কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়না। এজন্য এখানে Lipid nanoparticle ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি।
কোষের ভেতরে গিয়ে Nanoparticle টা ভেঙে যায় এবং mRNA টি কোষের মধ্যে উন্মুক্ত হয়। কোষের রাইবোজোম mRNA থেকে স্পাইক প্রোটিন তৈরী করে। এই স্পাইক প্রোটিন আমাদের দেহে Foreign particle হিসেবে বিবেচিত হয় এবং MHC-II এর সাহায্যে Antigen presenting cell (Macrophage, dendritic cell, B cell) এই স্পাইক প্রোটিনকে Naive T cell এর কাছে উপস্থাপন করে। পরবর্তীতে IL-4 এর উপস্থিতিতে এটি Helper-T cell এ পরিণত হয়। Helper-T cell থেকে IL-4 এবং IL-5 রিলিজ হয়; যার উপস্থিতিতে B cell, plasma cell এ রূপান্তরিত হয়। Plasma cell এরপর স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরী করে। এভাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনটি আমাদের দেহে কার্যকরী হয়। অর্থাৎ, সহজ ভাষায় বললে;
জিনোম থেকে স্পাইক প্রোটিন সংগ্রহ
⬇
mRNA তে রুপান্তর
⬇
mRNA টিকে Lipid nanoparticle এর সাথে যুক্তকরণ
⬇
মানবদেহে প্রবেশ
⬇
রাইবোজোমের mRNA থেকে স্পাইক প্রোটিন তৈরী
⬇
MHC-II এর মাধ্যমে Antigen presenting cell এর Naive T cell এর কাছে উপস্থাপন
⬇
Helper T cell তৈরী (IL-4 এর উপস্থিতিতে)
⬇
Helper T cell থেকে IL-4 এবং IL-5 রিলিজ
⬇
B cell এর Plasma cell এ রূপান্তর
⬇
এন্টিবডি তৈরী
⬇
ইমিউনিটি
ভ্যাকসিনটি তৈরীর পথে Moderna কে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।
- Lipid nanoparticle সাধারণত unstable হয় এবং এর মধ্যে এত বড় mRNA স্থাপন করাও প্রায় অসম্ভব।
- Lipid nanoparticle টি “Biodegradable”নয়। যার কারণে এটি লিভারে জমা হয়ে দেহে টক্সিসিটি ঘটাতে পারে।
- আমাদের দেহ বাহির থেকে আসা যেকোনো mRNA কে শনাক্ত করে ধ্বংস করতে সক্ষম। ভ্যাকসিনটিতে ব্যবহৃত mRNA যদি এন্টিবডি তৈরীর আগেই ধ্বংস হয়ে যায় তবে পুরো ভ্যাকসিনটিই ব্যর্থ হবে।
Moderna এইসব সমস্যার সমাধানও বের করেছে একে একেঃ
• নতুন ধরনের Nanoparticle উদ্ভাবন করা হয়েছে যা stable এবং এতে mRNA স্থাপন সম্ভব।
• Biodegradable lipid nanoparticles উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং আরো গবেষণা চলমান রয়েছে এই সমস্যা সমাধানের জন্য। যেহেতু মাত্র ২টি ডোজ দেয়া হবে, তাই লিভারে জমা হওয়া Nanoparticle ও হবে খুবই সামান্য।
• mRNA তে ব্যবহৃত Nucleotide গুলোকে Modify করা হয়েছে। এটিই সম্ভবত সবচেয়ে চমকপ্রদ উদ্ভাবন। Modified nucleotide ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন আমাদের দেহের ইমিউন সেল একে আক্রমণ করতে পারেনা, অন্যদিকে দেহের রাইবোজোম ও সহজে এর থেকে প্রোটিন তৈরী করতে সক্ষম।
Trial:
Phase-I এ ৪৫ জন মানুষের দেহে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৫৫ এর মধ্যে। ২৫ মাইক্রোগ্রাম, ১০০ মাইক্রোগ্রাম এবং ২৫০ মাইক্রোগ্রাম এই ৩টি মাত্রায় ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়। ২৫ এবং ১০০ মাইক্রোগ্রাম মাত্রায় দুটি ডোজ দেয়া হয়; প্রথম ডোজের ২৯ দিন পর। ২৫০ মাইক্রোগ্রামের ক্ষেত্রে একটিই ডোজ ব্যবহৃত হয়।
মূলত ভ্যাকসিনের সর্বোচ্চ নিরাপদ মাত্র পরীক্ষা করতেই ২৫০ মাইক্রোগ্রাম মাত্রাটি প্রয়োগ করা হয়। এদের মধ্যে ৮জনের দেহে দেহে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার ১৪দিন পর অর্থাৎ মোট ৪৩ দিন পর “Neutralizing antibody” পাওয়া যায় যেটি SARS CoV-2 ভাইরাসকে থামাতে সক্ষম। ৮ জনের মধ্যে ৪জনের দেহে যথেষ্ট পরিমাণ এন্টিবডির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় এন্টিবডির তুলনায় অনেক বেশি। এদের মূলত ১০০ মাইক্রোগ্রাম মাত্রায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। বাকি ৪ জনের দেহে ২৫ মাইক্রোগ্রাম মাত্রায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। ৮ জনের থেকে সাফল্য পাওয়া গেলেও বাকিদের ব্যাপারে কোনো তথ্য Moderna প্রকাশ করেনি। তবে সবার দেহেই এন্টিবডি তৈরী হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটি দাবী করে।
Phase-I এর অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একজনের (১০০ মাইক্রোগ্রাম মাত্রা) ভ্যাকসিন প্রয়োগের জায়গাটিতে Grade 3 Erythema(Redness) দেখা যায়। এছাড়া ৩জনের মধ্যে(২৫০ গ্রাম মাত্রা) Grade-3 systemic symptoms দেখা যায়। প্রতি ক্ষেত্রেই এই উপসর্গগুলো ছিলো সাময়িক এবং নিজে থেকেই সেরে যায়। কারোর ক্ষেত্রেই Grade-4 symptoms(life threatening) দেখা যায়নি।
Phase-II তে মূলত ভ্যাকসিনটির Reactogenicity এবং Immunogenicity পরীক্ষা করা হয়। এতে ৬০০ জন সেচ্ছাসেবক দুটি দলে বিভক্ত হয়ে অংশ নিয়েছেন। একদলের বয়স ১৮ থেকে ৫৫ এর মাঝামাঝি।অন্যদলের বয়স ৫৫ বা এর উপরে।Phase-II এ ৫০ মাইক্রোগ্রাম এবং ১০০ মাইক্রোগ্রাম এই দুটি মাত্র ব্যবহৃত হয়। এই ৬০০ জনকে আগামী ১বছর পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
জুলাই মাসকে Phase-III এর সাম্ভাব্য সময় হিসেবে ঠিক করা হয়েছে যাতে প্রায় ৩০০০০ জন স্বেচ্ছাসেবক অংশ নিবেন।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং দ্রুততা সত্ত্বেও কিছু বিশেষজ্ঞ এই ভ্যাকসিনটির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন,
• কোনো গবেষণাপত্রের মাধ্যমে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ না করা।
• সেচ্ছাসেবকদের পরিচয় প্রকাশ না করা।
• ৪৩ জনের মধ্যে ৩৫ জনের ব্যাপারে কোনো তথ্য না দেয়া।
• এবং সর্বোপরি এর পূর্বে Moderna এর কোনো ভ্যাকসিন বাজারজাত না হওয়া।
তবে এত অভিযোগের মাঝেও Moderna কিন্তু থেমে নেই। ইতোমধ্যেই তারা ৪৩৮ মিলিয়নের নতুন চুক্তি সম্পন্ন করেছে এবং তাদের ভ্যাকসিন সফল হলে ২০২১ সালের প্রথম অর্ধ থেকেই তারা ভ্যাকসিন বাজারজাতকরণ শুরু করবে, বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডোজ উৎপাদনের সক্ষমতা নিয়ে। এছাড়াও Moderna এর কোনো ভ্যাকসিন বাজারজাত না হলেও এদের ৯টি ভ্যাকসিন ট্রায়ালের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হল Zika vaccine, CMV vaccine,EBV vaccine,Influenza(H7N9) vaccine। এছাড়া ইঁদুরের ওপর(Phase-0) ভ্যাকসিনটি প্রয়োগে করে সাফল্য পাওয়া গিয়েছে। এই ক্রান্তিকালে এটুকু আশা সঞ্চার করাও বা কম কিসে! ধুঁকতে থাকা এই পৃথিবী নাহয় আশা নিয়েই বেচেঁ থাকবে;সেটা যতটা ক্ষীণ বা ক্ষুদ্রই হোক না কেন ।
মোঃ আদিব সিদ্দিকী
হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ
সেশনঃ২০১৭-২০১৮