Blog

সার্জারির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: পর্ব-০৪

প্রথম পর্বে উল্লেখিত সেই ক্ষতস্থানে গরম তেল ঢেলে দেওয়া আর পুরাতন Cauterisation পদ্ধতি (অর্থাৎ, তপ্ত লোহার ছ্যাঁকা)- এর কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। আহত মানুষদের সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন যিনি, আজ তাঁর সম্পর্কে জানলে কেমন হয়?

ষোড়শ শতাব্দীর একজন French Army Surgeon কীভাবে হয়ে উঠলেন Surgery-এর অন্যতম জনক, আজ লিখছি সেই কথা।

আমব্রাস পাঁড়ে (Ambroise Paré) জন্মগ্রহণ করেন ফ্রান্সে, ১৫১০ সালে। ঘটনাবহুল ছিল তার জীবন।

বাবা ছিলেন কারিগর। বড় ভাই ছিলেন Paris এর একজন Barber surgeon। প্রথমে পাঁড়ে তাঁর ভাইয়ের কাজ দেখে দেখেই শেখেন। এরপর ফ্রান্সের সবচেয়ে পুরাতন এবং একমাত্র পাবলিক হাসপাতাল থেকে শিক্ষা নেন। কিন্তু “Barber Surgeon” হওয়ার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার মত টাকা তাঁর কাছে ছিল না। তাই তিনি আর্মিতে ঢুকে যান। (সেটা তাঁর জন্য একদিক থেকে ভালই হয়েছিল। কেননা, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে নিজের কাজ অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।) আজ তিনি পরিচিত Battlefield Medicine– এর অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে।

যখনকার কথা বলছি, তখন চারপাশে যুদ্ধ লেগেই থাকতো। আহত মানুষদের সুস্থ করে তোলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। ভয়াবহতার কথা বুঝানোর জন্য ১৫৩৬ সালে মিলানের যুদ্ধের একটা ঘটনাই যথেষ্ট। পাঁড়ে সেখানে দুইজন সৈনিককে গুলিবিদ্ধ এবং দগ্ধ অবস্থায় পান। অন্য এক সৈনিক এসে পাঁড়েকে জিজ্ঞেস করে বুঝলো যে তাঁদের বাঁচার কোন আশাই নেই। তখন সে দ্রুত ছুরি বের করে দুইজনের গলা কেটে দিল। পাঁড়ে সেই দৃশ্য দেখে রাগে-দুঃখে চিৎকার করে উঠলো। সেই সৈনিক তখন বললো, নিজে এমন আহত হলে যে কেউই চাইবে কেউ তাঁকে মেরে ফেলে এই কষ্ট দূর করুক!

বন্দুকের গুলির আঘাতের জায়গায় ফুটন্ত তেল ঢেলেই পাঁড়ে প্রথমদিকে চিকিৎসা করতেন। কিন্তু একবার যুদ্ধক্ষেত্রে তেল শেষ হয়ে গেল। এদিকে তার কাছে একের পর এক আহত সৈনিক আসতে থাকলো। উপায় না দেখে তিনি রোমানদের পুরাতন পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। ডিমের সাদা অংশ, গোলাপজল আর তার্পিন-এর মিশ্রণ ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন। তার এই কাজ দেখে আশেপাশের সবাই বিরক্ত হলো। অনেকে বলেও ফেললো, এই সৈন্যরা একদিনও বাঁচবে না! এসব শুনে পাঁড়েও বিচলিত হয়ে গেছিলেন। তাই রাতের অন্ধকার কাটতেই রোগীদের দেখতে গেলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, যাদের ক্ষতস্থানে গরম তেল দেওয়া হয়েছিল তারা ব্যাথায় কাৎরাচ্ছে, ক্ষতস্থানে লাল হয়ে ফুলে গেছে, অনেকে মারাও গেছে। কিন্তু নতুন চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীরা ঘুমিয়ে আছে। ক্ষতস্থানের অবস্থাও অন্যদের চেয়ে ভাল।

এরপর থেকে তিনি এই মিশ্রণ ব্যবহার করতে লাগলেন। তবে অন্যেরা এর ব্যবহার শুরু করে ১৫৪৫ সালে তার বই (Methods of Treating Wounds) বের হওয়ার পর থেকে।

দ্রুত ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করার জন্য তখন তপ্ত লোহার ছ্যাঁক দেয়া হতো (cauterisation)। সিল্কের সুতা দিয়ে ক্ষতস্থান সেলাই করার কথা সবাই জানতো। কিন্তু তাতে রক্তপাত বন্ধে বেশি সময় লাগতো বলে কেউ সেলাই করতো না। অথচ লোহার ছ্যাঁক দেওয়ার ফলে প্রায়ই রোগী shock-এ চলে গিয়ে মারা যেত। এসব দেখে পাঁড়ে সেলাই করাকেই বেঁছে নিলেন। সাথে রক্তপাত কমাতে Galen’s এর artery সেলাই করার পদ্ধতিটা আবার চালু করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এজন্য তিনি বিশেষভাবে design করলেন “Crow’s Beak” নামের হেমোস্ট্যাট (Haemostat), যেটাকে আধুনিক Haemostat এর পূর্বপুরুষ বলা যায়। এছাড়াও তিনি limb prosthesis থেকে শুরু করে ocular prosthesis পর্যন্ত design করেছেন।

১৫৬৪ সালে প্রকাশিত তাঁর বই “Treatise on Surgery”-তে amputation এর সময় রক্তপাত কমানোর এই পদ্ধতিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। Infection এর কারণ জানার প্রায় ৩০০ বছর আগের কাহিনী এটা! তখনো antiseptic সম্পর্কে কারো ধারণা ছিল না। তাই প্রচুর infection হলেও আগের যেকোন পদ্ধতির চেয়ে তখন পাঁড়ের পদ্ধতিগুলো surgery এর দুনিয়া বদলে দিয়েছিল। এজন্য তাঁকে বলা হয় Surgical Techniques এর পথিকৃৎ।

Phantom Limb বা “ফ্যান্টম লিম্ব” খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার। এটা মূলত কেটে ফেলে দেওয়া অঙ্গে চুলকান বা ব্যথা অনুভব করা! এ সম্পর্কে পাঁড়ে বর্ণনা করেছেন আহত সৈনিকদের amputation নিয়ে কাজ করতে গিয়ে। তখন এটা নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা কারোরই তেমন ছিল না। পাঁড়েই প্রথম ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন যে এই অনুভূতির উৎস মস্তিষ্ক (কেটে ফেলা অঙ্গের বাকি অংশ নয়)। আজ আমরা জানি, সেটাই সঠিক!

Surgery এর সাথে সাথে তিনি কিন্তু Modern Forensic Pathology এরও জনক! তাঁর লেখা বিভিন্ন পদ্ধতি থেকেই মূলত Modern Forensic Pathology এর পথচলা শুরু। তিনি কোর্টসহ বিভিন্ন legal report লেখার পদ্ধতি প্রচলন করেছেন। আবার violent death এর ক্ষেত্রে internal organ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ভূমিকাও বর্ননা করেছেন।

১৫৪২ সালে এক ফ্রেঞ্চ কমান্ডারের কাঁধে লাগা গুলি খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন পাঁড়ে বুদ্ধি করে কমান্ডারকে ঠিক সেইভাবে দাঁড়াতে বললেন যেভাবে তিনি গুলি খাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর তিনি শত্রুপক্ষের অবস্থান হিসাব করে গুলির অবস্থান বের করে ফেললেন!

ওদিকে ১৫৬৭ সালের বিখ্যাত এক ঘটনায় পাঁড়ে Forensic Toxicology-তেও ছাপ ফেলেন। তখনকার দিনে এক ধরনের পাথরকে (Bezoar stone) সবরকম বিষের antidote হিসেবে বিশ্বাস করা হতো। এটা নিয়ে পাঁড়ের সন্দেহ ছিল। তখনই এক রাধুনীকে চুরির অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। পাঁড়ে তখন একটা পরীক্ষা চালালেন। তিনি রাধুনীকে বিষপানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করানোর জন্য রাজি করালেন এই শর্তে যে, বিষপানের পর এই পাথরের জন্য যদি সে বেঁচে যায় তাহলে সে মুক্তি পাবে। কিন্তু দেখা গেল ৭ ঘন্টা পর প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে ঠিকই তার মৃত্যু হলো। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে এই পাথর সব ধরনের বিষের জন্য antidote হিসাবে কাজ করে না।

পাঁড়ে অন্যদের মত গতানুগতিক পদ্ধতিতে অন্ধের মত বিশ্বাস করতেন না, বরং চিন্তাভাবনা করে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ফলাফল দেখতেন। তাঁর “Journeys in Diverse Places” নামক বইতে তিনি সেসব অভিজ্ঞতার কথাই লিখেছেন।

তিনি ১৫৫২ সালে রাজদরবারে “Barber Surgeon” হিসেবে যোগদান করে পরপর চারজন ফ্রেঞ্চ রাজার (দ্বিতীয় হেনরি, দ্বিতীয় ফ্রান্সিস, চতুর্থ চার্লস এবং তৃতীয় হেনরি) সান্নিধ্যে কাজ করেন।

১৫৭৫ সালে তিনি তাঁর সবগুলো লেখা মিলিয়ে বই আকারে বের করলেন। যথরীতি তাঁকে মিথ্যুক-জোচ্চোর ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করে তিরস্কার করতে থাকলো medical community এর সবাই। তখন এই field-এ তিনটা level ছিলঃ

১মঃ Physician বা চিকিৎসক
২য়ঃ Master Surgeon
৩য়ঃ Barber Surgeon

পাঁড়ে ছিলেন সর্বনিম্ন লেভেলে। হিংসার বশে নিয়ম করা হলো যে মেডিকেলের কোন বই-ই Faculty of Medicine অর্থাৎ, Physician level এর অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা যাবে না! কিন্তু সরাসরি রাজার হস্তক্ষেপ থাকায় পাঁড়েকে এসবে ভ্রূক্ষেপ করতে হয়নি। ১৫৮৫ সালে তিনি তাঁর অপমানের উচিত জবাবসহ প্রকাশ করেন “The Apology and Treatise of Ambroise Paré”

মজার ব্যাপার হচ্ছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এত বড় দিশারী হওয়ার পরেও ধর্মের দিক থেকে তার নিস্তার ছিল না! ১৫৭২ সালের ২৪ আগস্ট ফ্রান্সের ভয়ংকর ধর্মযুদ্ধে প্রচুর মানুষ মারা পড়ছিল। পাঁড়েও খুব ঝামেলায় পড়েন। কিন্তু রাজা চতুর্থ চার্লস তাঁকে লুকিয়ে রেখে সেই যাত্রায় বাঁচিয়ে দেন। পরে ১৫৯০ সালে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে।

চিকিৎসকরা প্রায়শই বলে থাকেন “আমাদের যতটুকু করা সম্ভব আমরা করেছি, বাকিটা উপরওয়ালার হাতে”। ১৫৩৭-৩৮ সালের দিকে ক্যাপ্টেন র‍্যাটের চিকিৎসার পর নিজের নোটপত্রে পাঁড়ে প্রথম লেখেন “I bandaged him and God healed him”। রোগী ভাল হয়ে গেলে তিনি সর্বদা বলতেন “I treated him. God cured him”. অর্থাৎ, চিকিৎসকদের বহুল ব্যবহৃত এই বাক্যটার প্রবক্তা কিন্তু স্বয়ং পাঁড়ে!

আদিবা তাসনিম
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ
সেশনঃ ২০১২-১৩

প্ল্যাটফর্ম একাডেমিয়া / সৈয়দা হাবীবা হুমায়রা



Leave a Reply